১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্দের সময় বাংলাদেশের
মানুষ নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে পাকিস্তানীদের হাত থেকে বাংলাদেশের ভুমিকে মুক্ত
করেছিল। বিশ্বের মানচিত্রে চিত্রায়িত হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র। যে মানচিত্র ছিল
বাংলাদেশের মানুষের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ। কিন্ত রক্তের অর্জিত বাংলাদেশের সে ভুমি নিয়ে
গেল ভারত। বাংলাদেশের প্রধানমন্তী পেলেন সমুদ্র জয়। ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তে বিনিময়ে
অর্জিত বাংলাদেশর ভুমি ভারতকে দিয়ে আমরা করলাম সুমদ্র জয়।
এর চেয়ে বড় তামাশা আর কি হতে পারে। আমাদের
প্রধাম মন্ত্রী বললেন বাংলাদেশ সমুদ্র জয় করেছেন আবার ভারত বলছে তারা সমুদ্র জয়
করেছে।কিন্তু বাস্তবতা হল কোন মামলায় বা খেলায় কখন দুই দল জয় হতে পারে না। এটা
স্বাভাবিক নয়।
প্রিয় পাঠক আসুন আলোচনা করি আসলে কে সুমদ্র
জয় করলো। ভারত না বাংলাদেশ।
সমুদ্রে সীমানা এবং দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের
মালিকানাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বিরোধ চলছিল তার ‘মীমাংসা’ হয়েছে। দীর্ঘ শুনানির
পর গত সোমবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের আকারে রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক সালিশী আদালত
(পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন)। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দ্য হেগ-এ অবস্থিত
আদালতের পাঁচ বিচারপতির মধ্যে একজন ভারতীয় বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ করলেও বাকি
চারজনের অভিমতই সালিশী আদালতের রায় হিসেবে গৃহীত ও ঘোষিত হয়েছে। এ রায় সম্পর্কে
জানানোর জন্যই মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল
হাসান মাহমুদ আলী। তার ঠিক বাম পাশে ছিলেন আকাশে ওড়ার রেকর্ড সৃষ্টিকারী সাবেক
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। আয়োজন
দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, শেখ হাসিনার সরকার কোনো বড় ধরনের ‘সাফল্য’ অর্জন করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় এ সাফল্য ছিল আবারও ‘সমুদ্র জয়’। কিছুদিন আগে
মিয়ানমারের সঙ্গে ‘জয়ী’ হওয়ার কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী মাহমুদ আলী। তাকে সমর্থন
যুগিয়েছেন পাশে বসা দীপু মনি। নিজেদের সাফল্য ও সমুদ্র জয় সম্পর্কে জানাতে গিয়ে
তারা সালিশী আদালতের দেয়া রায়ের মূলকথাগুলো তুলে ধরেছেন। এতে দেখা গেছে, ভারতের সঙ্গে বিরোধ
ছিল প্রায় ২৫ হাজার ৬০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে। সালিশী আদালতের রায়ে
বিরোধপূর্ণ ওই এলাকা থেকে বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার
এলাকা। এর ফলে বাংলাদেশের মোট সমুদ্র সীমা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ
কিলোমিটার। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, সালিশী আদালতের এ রায়ের ফলে বিরাট টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকা ছাড়াও দুইশ
নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল
মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের ওপর
বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি বিবৃতি হিসেবে সঠিক মনে হলেও
তথ্য-পরিসংখ্যানগুলোর সত্যতা সম্পর্কে জানার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
অন্যদিকে দেশপ্রেমিক কোনো মহলই কিন্তু
রায়টিকে সরকারের মতো সমুদ্র জয় মনে করতে পারেননি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক
পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ তো বলেছেনই যে, এই রায়ের মাধ্যমে
সমুদ্রে ভারতের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ ‘জয়’ করে থাকলে করেছে ভারত।
এখানে আওয়ামী লীগ সরকারের উল্লাস করার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। কারণ, বিশেষ করে দক্ষিণ তালপট্টি
দ্বীপের মালিকানা না দিয়ে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হয়েছে সর্বাত্মকভাবে। উল্লেখ্য, তিন দশকের বেশি সময়
ধরে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর
¯্রােতের গতিপথ নিয়ে
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধ ও মতপার্থক্য চলছিল। বাংলাদেশ দাবি করেছে, মধ্যস্রোতের হিসাবে
হাড়িয়াভাঙ্গার প্রবাহের পশ্চিম তীরের স্রোতই দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে সৃষ্টি
করেছে। এই বক্তব্যের সমর্থনে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে নকশা, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান
তুলে ধরেছে। অন্যদিকে ভারতের বক্তব্য হলো, হাড়িয়াভাঙ্গার পূর্ব তীরের স্রোতই বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত মূল স্রোতধারা। তাই
দক্ষিণ তালপট্টি বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমায় পড়ে না। এটা ভারতেরই আওতাভুক্ত। বিষয়টি
নিয়ে ভারত বছরের পর বছর সময় নষ্ট করেছে। এমনকি ২০০৮ সালের আগে দীর্ঘ ২৮ বছরে ভারত
বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো বৈঠকে বসেনি। ভারতীয়দের অবস্থানে পরিবর্তন ঘটেছিল জাতিসংঘের
সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত সনদ ঘোষিত হওয়ার পর। এই সনদে জাতিসংঘ বলেছিল, বাংলাদেশকে ২০১১ সালের
২৭ জুলাইয়ের মধ্যে এবং ভারতকে ২০০৯ সালের ২৯ জুনের মধ্যে গভীর ও বহির্সমুদ্রসীমা
সম্পর্কে নিজ নিজ দাবি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সমুদ্রতট থেকে
বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে প্রত্যেক দেশ ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দাবি করতে
পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমানায় সার্বভৌম অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার
ব্যাপারে কোনো সরকারই উদ্যোগ না নেয়ায় বাংলাদেশ তার অবিচ্ছেদ্য অংশ দক্ষিণ
তালপট্টি, নিউমুর এবং পূর্বাশা দ্বীপের ওপর নিজের দাবি ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে
পারেনি।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বৈঠকে সব সময়
দুটি বিষয় প্রাধান্যে এসেছে। প্রথমটি হলো, কোন কেন্দ্রবিন্দু বা স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে নিজস্ব সমুদ্র সীমা ধরা হবে।
দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর প্রবাহ সম্পর্কিত। উল্লেখ্য, হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর
প্রবাহের সঙ্গে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানার প্রশ্ন সরাসরি সম্পর্কিত।
এলাকাটি পর্যবেক্ষণ করে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন, দক্ষিণ তালপট্টি ও
ভারতীয় ভূখ-ের মাঝামাঝি নতুন ক্ষুদ্র দ্বীপ এবং বাংলাদেশের রায়মঙ্গল নদীর মুখে
উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত দ্বীপÑ এই তিনটি ভূখ- হাড়িয়াভাঙ্গা ও রায়মঙ্গল নদীর প্রবাহকে পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে
তুলেছে। দক্ষিণ তালপট্টি হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর গতিধারায় অবস্থিত নয়। দ্বীপটি নদীর
পূর্বদিকে এবং রায়মঙ্গল নদীর স্রোতধারার পশ্চিম পাশে অবস্থিত। যেহেতু ভারত ও
পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণকারী র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর
মধ্যস্রোত বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত ও স্বীকৃত, সেহেতু দক্ষিণ
তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে কোনো বিরোধ বা প্রশ্ন থাকতে পারে না। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের।
কিন্তু ভারত শুধু বাংলাদেশের মালিকানা অস্বীকার করে এবং দক্ষিণ তালপট্টির ওপর
নিজের মালিকানার দাবি জানিয়েই থেমে থাকেনি, বিভিন্ন উপলক্ষে দ্বীপটি নিয়ে যৌথ জরিপের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে।
শেষ পর্যন্ত ‘জয়’ও করেছে ভারতই। আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ হলো, শুধু তেল-গ্যাস নয়, সমুদ্রের তলদেশে অন্য অনেক সম্পদও রয়েছে। সুতরাং বিশেষ করে বাংলাদেশের
অবিচ্ছেদ্য অংশ দক্ষিণ তালপট্টিকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েও যারা সাফল্যের দাবি
জানাচ্ছেন তাদের সঙ্গে একমত হওয়া যায় না। আমরা বরং মনে করি, রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্য
অনেক বিষয় ও ক্ষেত্রের মতো সমুদ্র সীমা ও দক্ষিণ তালপট্টির প্রশ্নেও ভারতের
সেবাদাসগিরি করা হয়েছে কি না সে ব্যাপারে দেশপ্রেমিকদের উচিত অনুসন্ধান করার
উদ্যোগ নেয়া এবং সরকার ও ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার কোনো গোষ্ঠী ভারতের পক্ষে ভূমিকা
পালনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। কারণ, যে কোনো ব্যাখ্যায় এটা
রাষ্ট্রদ্রোহিতা পর্যায়ের গুরুতর অপরাধ। এ ধরনের কর্মকা-ের কারণেই আমাদের সমুদ্র
এলাকা সংকীর্ণ হয়ে এসেছে এবং বিরাট এলাকা বেদখল হয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় সম্পদও
লুণ্ঠিত হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। সুতরাং সরকারের উচিত তথাকথিত সাফল্যের ঢেঁকুর তুলে
জনগণকে বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে একদিকে সঠিক তথ্য জানানো এবং অন্যদিকে বিশেষ করে
দক্ষিণ তালপট্টির মালিকানা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দ্রুত সচেষ্ট হয়ে ওঠা। কারণ, প্রশ্ন এখানে জাতীয়
স্বার্থের এবং সার্বভৌমত্বেরও।
No comments:
Post a Comment